সেকেন্ড রিপাবলিক গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এনসিপি’র আত্মপ্রকাশ


Sarsa Barta প্রকাশের সময় : মার্চ ১, ২০২৫, ৯:০১ পূর্বাহ্ণ / ০ Views
সেকেন্ড রিপাবলিক গড়ার প্রত্যয় নিয়ে এনসিপি’র আত্মপ্রকাশ
  • ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ স্লোগানে নতুন দল এনসিপি’র আত্মপ্রকাশ আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন; এ ছাড়াও গুরুত্বপূর্ণ পদ পেয়েছেন হাসনাত আবদুল্লাহ, সারজিস আলম, সামান্তা শারমিন, আরিফুল ইসলাম আদীব, ডা. তাসনিম জারা, নাহিদা সারওয়ার নিবা, নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী, আব্দুল হান্নান মাসউদ

অবশেষে আত্মপ্রকাশ করলো ছাত্রদের আলোচিত রাজনৈতিক দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। ‘কিংস পার্টি’ নাকি আমজনতার পার্টি এ বিতর্কের মধ্যেই যাত্রা শুরু করলো নতুন দলটি। দল গঠনের আগে উপদেষ্টা পদ থেকে পদত্যাগ করেন নাহিদ ইসলাম। যদিও এখনো ছাত্র প্রতিনিধিদের দু’জন সদস্য এখনো অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে রয়ে গেছেন।

গতকাল শুক্রবার বৈষম্যহীন সমৃদ্ধ সুন্দর বাংলাদেশ গঠনের অঙ্গীকার নিয়ে উৎসব মুখর পরিবেশে বিপুল ছাত্র-জনতার উপস্থিতিতে নতুন দল ‘জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঘোষণা দেয়া হয়। দলটির ইংরেজি নাম ‘ন্যাশনাল সিটিজেনস পার্টি’ (এনসিপি)। রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে শহীদ মো. ইসমাইল হাসান রাব্বির বোন মিম আক্তার যখন দলের নাম ঘোষণা করেন তখন লাখো শিক্ষার্থীর পাশাপাশি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থেকে হর্ষধ্বনি দিয়ে নতুন দলকে স্বাগত জানান।

নতুন দলের নাম ঘোষণা করে মিম আক্তার বলেন, আপনাদের মনে আছে- গত ৫ আগস্ট দুই বোনের কাঁধে ভাইয়ের লাশ; সে দুই বোনের মধ্যে আমি একজন। ইতিহাসে এমন ঘটনা আর ঘটে নাই। তিনি বলেন, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানের পর ছাত্র-জনতার নেতৃত্বে নতুন রাজনৈতিক দলের নাম জাতীয় নাগরিক পার্টি ঘোষণা করছি। এসময় তিনি আহ্বায়ক হিসেবে নাহিদ ইসলাম এবং সদস্য সচিব হিসেবে আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করেন। এরপর সদস্য সচিব আখতার হোসেন আহ্বায়ক কমিটির অন্যান্য পদের নাম ঘোষণা করেন। এর মধ্যে সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব। সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা ও নাহিদা সারওয়ার নিবা। মুখ্য সংগঠক (দক্ষিণাঞ্চল) এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে হাসনাত আবদুল্লাহকে এবং সারজিস আলমকে মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) এর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া দলটির মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী, যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান মাসউদ। এ ছাড়াও আরও বেশ কয়েকজন যুগ্ম সদস্য সচিব ও যুগ্ম সমন্বয়কের নাম ঘোষণা করা হয়। তবে সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন আজকে আমাদের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হলো। খুব শিগগিরই আমরা পূর্ণাঙ্গ আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে তা প্রকাশ করা হবে।

কমিটি ঘোষণার পর দলের নতুন আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম তার সূচনা বক্তব্য প্রদান করেন। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে ভারত ও পাকিস্তানপন্থী রাজনীতির ঠাঁই হবে না। আমরা বাংলাদেশকে সামনে রেখে, বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থকে সামনে রেখে রাষ্ট্রকে বিনির্মাণ করব। আমরা সেকেন্ড রিপাবলিক গড়তে চাই।’ নাহিদ ইসলাম জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকারী ছাত্র-জনতা, শহীদ পরিবারের সদস্য ও রাজনৈতিক দলের নেতাদের সংগ্রামী সালাম ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বক্তব্য শুরু করেন। তিনি বলেন, আমরা সামনের কথা বলতে চাই। পেছনের ইতিহাস অতিক্রম করে সম্ভাবনার বাংলাদেশের কথা বলতে চাই। নাহিদ ইসলাম জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ‘তুমি কে, আমি কে, বিকল্প, বিকল্প’ স্লোগানটি তুলে ধরে বলেন, বিকল্পের জায়গা থেকে এই নতুন দলের আত্মপ্রকাশ। আজকের মঞ্চ থেকে শপথ, বাংলাদেশকে বিভাজিত করা যাবে না। এরপর নাহিদ ইসলাম লিখিত বক্তব্য পাঠ করা শুরু করেন।

নাহিদের পাঠ করা ঘোষণাপত্রে বলা হয়, জুলাই ২০২৪ ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে, আমরা বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা এই মর্মে ঘোষণা করছি। আমরা হাজার বছরের ঐতিহাসিক পরিক্রমায় বঙ্গীয় বদ্বীপের জনগোষ্ঠী হিসেবে এক সমৃদ্ধ ও স্বকীয় সংস্কৃতি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। প্রায় ২০০ বছরের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ের পর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান রাষ্ট্রের পত্তন ঘটে। তবে শোষণ ও বৈষম্য থেকে এ দেশের গণমানুষের মুক্তি মেলেনি। ফলে দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে লাখো শহীদের রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম হয়; কিন্তু স্বাধীনতার পর দীর্ঘসময় ধরে বাংলাদেশের জনগণকে বারবার গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করতে হয়েছে।

১৯৯০ সালে ছাত্র-জনতা বুকের তাজা রক্ত দিয়ে সামরিক স্বৈরাচারকে হটিয়েছে। তথাপি, স্বাধীনতার পাঁচ দশক পেরিয়েও আমরা গণতন্ত্র, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত করেÑ এমন একটি রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে পারিনি। বরং বিগত ১৫ বছর দেশে একটি নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসনব্যবস্থা কায়েম হয়েছিল, যেখানে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থে বেপরোয়া ব্যবহার করে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করা হয়েছে। বিরোধী মতের কণ্ঠরোধ, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি ও অর্থ পাচারকে একটি রাষ্ট্রীয় সংস্কৃতিতে পরিণত করা হয়েছে। জুলাই ২০২৪-এ ছাত্র-জনতা বিপুল আত্মত্যাগের মাধ্যমে এক অভূতপূর্ব অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দীর্ঘ দেড় দশক ধরে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী সরকারের পতন ঘটিয়েছে; কিন্তু আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, হাজারো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা কেবল একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি।

জনগণ বরং রাষ্ট্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী-ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাক্সক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিল, যেন জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়। সেই লক্ষ্য নিয়েই আমরা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দিচ্ছি। এটি হবে একটি গণতান্ত্রিক, সমতাভিত্তিক ও জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী রাজনৈতিক দল। তিনি তার ঘোষণা পত্রে বলেন, এই নতুন বাংলাদেশ গড়ায় আমরা সবাই প্রত্যেকে যার যার অবস্থান থেকে শপথ করি। ঐক্যবদ্ধ হই এবং আমাদের কাক্সিক্ষত সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দৃঢ়চিত্তে এগিয়ে যাই। আমাদের দেশ, আমাদের অধিকার, আমাদের ভবিষ্যত আমাদের সেকেন্ড রিপাবলিক অধরা কোনো স্বপ্ন নয়, এটি আমাদের প্রতিজ্ঞা!

বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠান শুরু হয়। শুরুতে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতা তারেকুল ইসলাম (তারেক রেজা)। পরে অন্যান্য ধর্মীয় গ্রন্থ থেকে পাঠ করা হয়। ধর্মগ্রন্থ থেকে পাঠের পর জাতীয় সংগীত পরিবেশন করা হয়। এরপর জুলাই আগস্টে নিহতদের স্মরণে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয় এবং নিজ নিজ ধর্মমতে তাদের জন্য দোয়া ও প্রার্থনা করা হয়।

এর আগে স্লোগানে স্লোগানে মিছিল নিয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউয়ে জড়ো হন বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা। ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ জাতীয় নাগরিক পার্টির এই দলীয় স্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে গোটা এলাকা। দলের সব নেতাও ইনকিলাব জিন্দাবাদ এই স্লোগানের মাধ্যমে তাদের বক্তব্য শেষ করেছেন। জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘিরে পতাকা হাতে মিছিল নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন আগত ছাত্র জনতা। দেশের বিভিন্ন জেলা, উপজেলা, মহানগর, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে হাজির হন ছাত্র-জনতা। বেলা ৩টার আগেই কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ। আগত সবার চোখেমুখে নতুন স্বপ্ন।

ময়মনসিংহ থেকে আসা মাঝ বয়সী ফোরকান আহমেদ বলেন, ২৪ এর সেই জুলাই আন্দোলনে আমরা তরুণদের প্রতি ভরসা রেখেছি। এখনো তাদের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। আমরা বিশ্বাস করি তারা ভাল কিছু করবে, নতুন কিছু করবে। তিতুমীর কলেজ থেকে এসেছেন জুনায়েদ আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নিয়ে জনগণের সামনে হাজির হয়েছি। বাংলাদেশের মানুষ আমাদের পাশে আছে।’ জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশের অনুষ্ঠানে সার্বিক নিরাপত্তায় দায়িত্ব পালন করেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। আয়োজনকে কেন্দ্র করে মেডিকেল টিম, অস্থায়ী ওয়াশ রুম, পুলিশ বুথ, নারীদের জন্য বুথ, ভিআইপি বুথ ও পানির ব্যবস্থা করা হয়।

জাতীয় নাগরিক পার্টির আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বিএনপি জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ। তাদের মধ্যে ছিলেন, বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী, যুগ্ম মহা সচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, ঢাকা মহানগরী দক্ষিণের আমির নুরুল ইসলাম বুলবুল, বিকল্পধারা বাংলাদেশের নির্বাহী সভাপতি মেজর (অব.) আবদুল মান্নান, বাংলাদেশ এলডিপির মহাসচিব শাহাদাত হোসেন সেলিম, খেলাফত মজলিসের নেতা আহমেদ আবদুল কাদের, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা আকবর খান, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের জেনারেল সেক্রেটারি মাওলানা জালাল উদ্দিন আহমেদ, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রেসিডিয়াম সদস্য আশরাফ আলী আকন্দ, হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির আহমদ আলী কাসেমী, লেবার পার্টির চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান ইরান, ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব সাখাওয়াত হোসেন রাজী, ডেভেলপমেন্ট পার্টির চেয়ারম্যান এ কে এম আজহারুল ইসলাম, এবি পার্টির মহাসচিব ব্যারিস্টার আসাদুজ্জামান ফুয়াদ প্রমুখ।